রোজা রেখে অসুস্থ হলে করণীয়: রমজান মাসে রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি এবং এটি মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। রোজার মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন এবং আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হন। তবে অনেক সময় রোজা রাখার সময় শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে, যেমন মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, হাইপোগ্লাইসেমিয়া, বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যা। এমন পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। আজকের এই নিবন্ধে আমরা জানবো, রোজা রেখে অসুস্থ হলে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে এবং ইসলামিক নির্দেশনা অনুযায়ী কী করতে হবে।
রোজা রেখে অসুস্থ হলে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ
ইসলাম একটি সহজ ও সহনশীল ধর্ম, যা মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান। যদি কোনো ব্যক্তি রোজা রাখার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রোজা রাখা তার জন্য শারীরিকভাবে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, তবে ইসলামে সেই ব্যক্তির জন্য রোজা ভাঙার অনুমতি রয়েছে।
- কুরআনের নির্দেশনা
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি অসুস্থ অথবা ভ্রমণে থাকে, সে অন্য সময়ে এই রোজাগুলো পূর্ণ করবে।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮৫)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ মানুষকে কষ্টে ফেলতে চান না; বরং তাদের সুরক্ষা এবং সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য অব্যাহতি দিয়েছেন। - হাদিসের নির্দেশনা
হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “তোমরা কষ্টের মধ্যে থাকলে রোজা রাখো না।” এই হাদিসের ভিত্তিতে বোঝা যায়, রোজা রাখতে গিয়ে যদি শারীরিক কষ্ট সহ্য করার অক্ষমতা দেখা দেয়, তাহলে রোজা ভাঙা অনুমোদিত এবং এটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।
আরো পড়তে পারেন
রোজা রেখে অসুস্থ হলে কী কী লক্ষণ দেখা দিতে পারে?

রোজা রাখার সময় শারীরিক অসুস্থতার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা দেখা দিলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এসব লক্ষণ অবহেলা করলে তা বড় আকার ধারণ করতে পারে।
১. মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা অনুভব করা
রোজার সময় দীর্ঘক্ষণ খাবার না খাওয়ায় অনেক সময় মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণত কম রক্তচাপ বা রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে হয়।
২. বমি বা বমি বমি ভাব
কিছু ক্ষেত্রে রোজার সময় অস্বস্তি বোধ বা বমি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা শারীরিক দুর্বলতা বাড়িয়ে দেয়।
৩. বুক ধড়ফড় করা বা শ্বাসকষ্ট
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে শরীরের শক্তি কমে যায়, যার ফলে বুক ধড়ফড় করা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
৪. অত্যধিক তৃষ্ণা অনুভব করা
দীর্ঘ সময় পানি না খাওয়ায় তৃষ্ণা অনুভব হয় এবং শরীর পানিশূন্যতায় ভুগতে পারে।
রোজা রেখে অসুস্থ হলে করণীয় পদক্ষেপসমূহ
রোজা রেখে যদি উপরের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত যাতে রোজা রেখে সুস্থ থাকা যায়।
১. বিশ্রাম নিন এবং শারীরিক পরিশ্রম কমান
রোজার সময় শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে বিশ্রাম নিলে শরীর শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং দুর্বলতা কমে।
- বিশ্রামের গুরুত্ব
রোজার সময় অতিরিক্ত কাজ করলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যাদের শারীরিক দুর্বলতা বেশি, তাদের রোজার সময় বিশ্রামের ওপর জোর দেওয়া উচিত।
২. তাজা বাতাস নিন এবং শীতল পরিবেশে থাকুন
অসুস্থ বোধ করলে শীতল স্থানে বসে তাজা বাতাস গ্রহণ করলে শরীরকে আরাম দেয়। এটি মাথা ঘোরা বা বুক ধড়ফড়ের মতো সমস্যাগুলো কমাতে সহায়ক।
৩. শরীর হাইড্রেটেড রাখুন
ইফতার এবং সেহরির সময় প্রচুর পানি পান করুন এবং পানি শূন্যতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করুন। দেহে পানির ভারসাম্য বজায় থাকলে অসুস্থতার ঝুঁকি কমে যায়।
- পানিশূন্যতা এড়াতে সেহরিতে পানি পান
সেহরির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করলে সারাদিন শরীর হাইড্রেটেড থাকে, যা অসুস্থতার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
৪. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন
সেহরি ও ইফতারের সময় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলে শরীর সঠিক পরিমাণে শক্তি পায় এবং অসুস্থতার ঝুঁকি কমে যায়। প্রোটিন, শর্করা, এবং ভিটামিনযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া উচিত।
রোজা ভাঙা প্রয়োজন হলে কী করবেন?

যদি শরীর এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে রোজা রাখা অসম্ভব হয়ে যায়, তবে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা ভাঙার অনুমতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
- রোজা ভাঙা ও পরবর্তীতে কাজা রাখা
অসুস্থতার কারণে রোজা ভাঙতে হলে সেই রোজা পরবর্তীতে কাজা করতে হবে। তবে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলে কাজা রোজা পালন করা আবশ্যক। - কাফফারার প্রয়োজন নেই
অসুস্থতার কারণে রোজা ভাঙলে কোনো কাফফারা প্রয়োজন নেই; বরং সুস্থ হলে কাজা রোজা পালন করাই যথেষ্ট।
রোজা রেখে অসুস্থতা এড়াতে কিছু পরামর্শ
রোজা রেখে সুস্থ থাকার জন্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে অসুস্থতার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
১. অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন
মসলাযুক্ত খাবার তৃষ্ণা বাড়ায় এবং শরীরের পানি শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সেহরিতে অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
২. ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় কম পান করুন
ক্যাফেইন শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি করতে পারে, তাই সেহরি বা ইফতারে বেশি চা বা কফি পান না করাই ভালো।
৩. অল্প অল্প করে খাবার গ্রহণ করুন
ইফতারের সময় একসঙ্গে বেশি খাবার না খেয়ে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে খাবার খাওয়া উচিত, যাতে হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা না হয়।
ইসলামে রোগী ও অসুস্থদের জন্য রোজার অব্যাহতি | রোজা রেখে অসুস্থ হলে
ইসলাম একটি সহজ ধর্ম, যা মানুষের শারীরিক অবস্থা ও স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আল্লাহ মানুষকে কষ্টে ফেলার জন্য রোজার বিধান দেননি; বরং এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম।
- অসুস্থদের জন্য আল্লাহর করুণা
ইসলামে রোগী এবং অসুস্থদের জন্য রোজা পালনে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহর বিশেষ করুণার বহিঃপ্রকাশ। এতে বোঝা যায়, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল।
উপসংহার | রোজা রেখে অসুস্থ হলে
রোজা রেখে অসুস্থ হলে শরীরের অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রোজা রাখা তার জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে রোজা ভেঙে ফেলা অনুমোদিত। পরে সেই রোজার কাজা আদায় করা ফরজ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের রোজা পালন করার তৌফিক দান করুন এবং এই ইবাদতের মাধ্যমে আমাদের শারীরিক ও আত্মিক উন্নতি দান করুন।